হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, মহররম হলো সেই শোক ও বেদনার মাস, যা নবী (সা.) ও আলী (আ.)-এর অনুসারীদের অন্তরকে যুগ যুগ ধরে বিষণ্ন করে রেখেছে। হিজরি ৬১ সালের মহররম থেকে আজ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ এই মাসে হুসাইন (আ.) ও তাঁর সাথিদের মর্মান্তিক শাহাদাতের কারণে শোক পালন করে আসছেন। এক ভয়াবহ বিপর্যয়, যার বর্ণনা করাও অসম্ভব! কী দুঃখের বিষয়—যে হুসাইন (আ.) নবীর দৌহিত্র, আলী (আ.)-এর সন্তান, নবীর উত্তরসূরি, জামাতা ও খলিফা ছিলেন, তাঁকে নবীর ওফাতের মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে কারবালার প্রান্তরে হত্যা করা হলো—তা-ও সেইসব লোকদের দ্বারা যারা নিজেদের নবীর উম্মত বলে দাবী করত!
ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) এ বিষয়ে বলেছেন:
أَمْسَتِ الْعَرَبُ تَفْتَخِرُ عَلَى الْعَجَمِ بِأَنَّ مُحَمَّداً مِنْهَا وَ أَمْسَتْ قُرَیْشٌ تَفْتَخِرُ عَلَى الْعَرَبِ بِأَنَّ مُحَمَّداً مِنْهَا وَ أَمْسَى آلُ مُحَمَّدٍ مَخْذُولِینَ مَقْهُورِینَ مَقْبُورِینَ.
“আরবরা আজ গর্ব করে যে, মুহাম্মদ (সা.) তাদের মধ্য থেকে ছিলেন; কুরাইশ গর্ব করে যে, মুহাম্মদ (সা.) তাদের গোত্র থেকে ছিলেন; অথচ আজ আলে মুহাম্মদ (সা.) লাঞ্ছিত, নির্যাতিত ও শহীদ অবস্থায় শায়িত।”
এই কারণেই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের শোক কখনও ফুরায় না। মহানবী (সা.) বলেছেন:
إِنَّ لِقَتْلِ الْحُسَیْنِ حَرَارَةً فِی قُلُوبِ الْمُۆْمِنِینَ لَا تَبْرُدُ أَبَدا.
"নিশ্চয়ই হুসাইনের শাহাদাতে মুমিনদের অন্তরে এমন এক উত্তাপ রয়েছে, যা কখনও শীতল হবে না।"
কারবালা শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এক চিরন্তন আদর্শ—যা গত চৌদ্দ শতাব্দীতে অসংখ্য মানুষকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে গড়ে তুলেছে। এমন অনেকেই আছেন, যারা মহররমের মজলিসে অংশ নিয়ে নিজের জীবনধারা বদলে ফেলেছেন।
কারবালা ও মহররম মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। মহররম মানুষকে জীবনের উদ্দেশ্য গভীরভাবে অনুধাবন করায়, জীবনে প্রকৃত অর্থ যোগ করে। এটি হলো তাওবার মাস—আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার মাস, সত্য খুঁজে পাওয়ার মাস, সঠিকভাবে জীবন ও মৃত্যু শেখার মাস। মহররম শেখায় কিভাবে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচা যায় এবং আত্মমর্যাদার সঙ্গে দুনিয়াকে বিদায় জানানো যায়।
মহররম ও কারবালা নৈতিকতার শিখর। এটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে আমাদের নৈতিকতা, ভালোবাসা, মুক্তি ও সম্মানের পাঠ শেখায়।
এই কারণেই আশ্চর্যের কিছু নেই যে মহররম এক রাতে এমনকি তার চেয়েও কম সময়ে মানুষকে বদলে দিতে পারে। অনেক পাপগ্রস্ত ব্যক্তি, যারা গুনাহের অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, এই মাসের সম্মানে সেই অভ্যাস ত্যাগ করেন। তাই মহররম এক "অঙ্গীকারের মাস"—আল্লাহর অবাধ্যতা ত্যাগ করার অঙ্গীকার, নৈতিক উৎকর্ষ অর্জনের অঙ্গীকার, আর এক কথায়—বন্দেগির অঙ্গীকার।
বন্দেগির অঙ্গীকার
আল্লাহর প্রকৃত ইবাদতের সূচনা হয় সেই স্থান থেকে, যেখানে মানুষ তাঁর নিষিদ্ধকৃত কাজগুলো ত্যাগ করে। এই পরিত্যাগের সূচনা হলো তওবা। কারবালার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত হলো—হুর ইবনে ইয়াজিদের তওবা ও ইমাম হুসাইনের (আ.) পক্ষে এসে শহীদ হওয়া।
ঐতিহাসিক বর্ণনায় আছে—আশুরার দিন, হুর বুঝতে পারেন যে ওমর ইবনে সাদের বাহিনী ইমামের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন সঠিক পথের। তিনি বলেন: "আল্লাহর কসম! আমি নিজেকে জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে দেখছি। আমি জান্নাত বেছে নিচ্ছি, যদিও সে জন্য আমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হোক বা পুড়িয়ে দেওয়া হোক!"
এরপর তিনি ঘোড়াকে স্পর্শ করে ইমামের দিকে এগিয়ে আসেন এবং বলেন: "হে রাসূলের পুত্র! আমিই সেই ব্যক্তি যে আপনাকে পথরোধ করেছিলাম, আমি জানি আমার কাজ ভুল ছিল। এখন আমি তওবা করে আপনার সহযোগিতায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই। আপনি কি আমার এই তওবা গ্রহণ করবেন?"
ইমাম হুসাইন (আ.) উত্তরে বলেন: "হ্যাঁ, আল্লাহ তোমার তওবা কবুল করুন। তুমি যেমন তোমার মা তোমার নাম রেখেছিলেন ‘হুর’ (স্বাধীন), ইনশাআল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তুমিও একজন মুক্ত মানুষ থাকবে।"
এইভাবেই হুর আল্লাহর বন্দেগির অঙ্গীকার করেন এবং মানব ও দানব শয়তানদের দাসত্ব থেকে মুক্তি পান।
আত্মমর্যাদা (عزت نفس)
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সম্মানিত করেছেন, তাকে সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ রূপে গড়ে তুলেছেন এবং সমগ্র সৃষ্টিকে মানুষের জন্য নিয়োজিত করেছেন। এমন একজন মানুষ কখনোই দুনিয়ার মোহে বা অন্য মানুষের দাসত্বে লিপ্ত হতে পারে না। এমনকি মৃত্যু হলেও সে তার সম্মান বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয়।
এইজন্যই ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন:
فَإِنِّی لَا أَرَى الْمَوْتَ إِلَّا سَعَادَةً وَ الْحَیَاةَ مَعَ الظَّالِمِینَ إِلَّا بَرَما.
“আমি মৃত্যুকে সফলতা ছাড়া কিছু দেখি না এবং জালিমদের সঙ্গে জীবনকে অপমান ছাড়া কিছু মনে করি না।”
এই হলো আশুরার শিক্ষা—যে কোনো অনুরোধ বা দাবী, যা মানুষের সম্মানে সামান্যতম আঘাত হানে, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
এই শিক্ষাই সকল হুসাইনপ্রেমীদের কথা ও আচরণে প্রতিফলিত হওয়া উচিত—বিশেষত ইসলামি দেশের শাসকদের মধ্যে, যেন তারা ইসলামবিরোধী শক্তির মুখোমুখি হলে সম্মানের সঙ্গে অবস্থান নেন এবং মুসলমানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। আমাদের রাজনীতি হওয়া উচিত হুসাইনির আদর্শে গঠিত—যার ভিত্তি হবে আত্মমর্যাদা, ঈমানের শক্তি ও দ্বীনের গৌরব।
জীবনের মূল্যায়ন
জীবনের মূল্য কোথায়? জীবনের লক্ষ্য কী? কেন আমরা বাঁচতে চাই? নিজের ও চারপাশের দুনিয়াকে সাজানো কতদূর পর্যন্ত যৌক্তিক?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে দুটি বড় দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়—
১. জাগতিক (ম্যাটেরিয়ালিস্টিক)
২. আধ্যাত্মিক/ঈশ্বরকেন্দ্রিক (থিওকেন্দ্রিক)
যদি মানুষ কেবল দুনিয়াকে চিন্তা করে এবং আখেরাতকে ভুলে যায়, তবে তার দৃষ্টিভঙ্গি হবে নিছক বস্তুবাদী। তখন সে দুনিয়াকে শুধু দুনিয়ার জন্য চায় এবং জীবনের সব প্রচেষ্টা কেবল আরাম-আয়েশের জন্যই নিবেদিত হয়। এমন এক জীবনযাপন যার শেষ নেই—শুধু শূন্যতা!
কিন্তু যদি কেউ দুনিয়াকে আখেরাতের পরিপ্রেক্ষিতে দেখে এবং চিরস্থায়ী জীবনের সাফল্যকে ক্ষণস্থায়ী সুখের চেয়ে অগ্রাধিকার দেয়, তবে সে জীবনকে যেকোনো মূল্যে গ্রহণ করবে না। কারবালার ময়দানে যে অল্প কিছু মানুষ এমন উচ্চতর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইমাম হুসাইনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তারাই আমাদের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষাদাতা।
অন্যদিকে, যারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল এবং রাসূলের (সা.) দৌহিত্রের রক্ত ঝরাতে দ্বিধা করেনি, তারা শুধু তাদের নিজের আরাম-আয়েশ ও পারিবারিক স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাদের জন্য দুনিয়ার সুখই সব কিছু ছিল।
মহররম আমাদের শেখায়—জীবনে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নয়
মহররম শিক্ষা দেয়—জীবন গঠনের ক্ষেত্রে কেবল দুনিয়াবি লক্ষ্য নয়, বরং আখেরাতকে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পরিবারের গঠন যেন শুধু আর্থিক দিক বিবেচনায় না হয়
সন্তান জন্ম দেওয়া যেন শুধুই ভোগবিলাসের চিন্তা থেকে না আসে
বিবাহ অনুষ্ঠান যেন কেবল আড়ম্বর ও খরচের প্রতিযোগিতা না হয়ে দাঁড়ায়
আর যদি এসবই নিছক দুনিয়াবি চিন্তা থেকে করা হয়, এবং তারপরও দাবি করা হয়—"আমরা ইসলামের অনুসারী", তবে আমাদের কথা ও কাজের মধ্যে বিরাট অসামঞ্জস্য থেকে যায়।
সারকথা:
আশুরা ও কারবালা আমাদের শেখায়—সম্মান ও আত্মমর্যাদা ছাড়া জীবন মূল্যহীন। হুসাইন (আ.) দেখিয়েছেন যে, জীবন শুধু বেঁচে থাকার নাম নয়, বরং মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা, এবং প্রয়োজন হলে সেই মর্যাদা রক্ষায় মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করা, এটাই প্রকৃত জীবনের শিক্ষা।
আপনার কমেন্ট